একগুচ্ছ চিঠি
–অঞ্জনা গোড়িয়া সাউ
“তাকে “এখন রাখা হয়েছে মানসিক হসপিটালে। একটা অন্ধকার বন্ধ ঘরে। আলো দেখলেই তার দৌরাত্ম বেড়ে যায়।
এম.এস.সি পাশ ছেলে।নাম কুন্তল।
যার চোখে ছিল একরাশ স্বপ্ন।
চাকরিটা পেলে, বোনের বিয়ে, ভায়ের পড়াশোনা, ডিভোর্সি দিদির ভবিষ্যৎ, বাবার চিকিৎসা করা – সব সম্ভব হবে।
কিন্তু দিনের পর দিন চাকরির পরীক্ষা দিতে দিতে ক্লান্ত অবসন্ন।
এমনই একদিন চাকরির পরীক্ষা দিয়ে ফিরছিল ট্রেনে। বেশ কিছু অপরিচিত মানুষ তার বন্ধু হয়ে ওঠে।
সারাদিন ট্রেনের কামরায় গল্প আড্ডায় জমে ওঠেছিল আসর।
কার মনে কী আছে কেউ জানে না।
একসাথে ডিনার করার পর যে যার শুয়ে পড়ে।
কিন্তু সকালে আর ঘুম ভাঙলো না কুন্তলের। জানি না কীভাবে কুন্তলের খাবারে কেউ কিছু মিশিয়ে দিয়ে ছিল।
তাই কুন্তল অজ্ঞান হয়ে যায় ।
সেই ফাঁকে বন্ধু বেশে মানুষ গুলো ততক্ষণে কুন্তলের কাছে যা কিছু ছিল সব কিছু নিয়ে ট্রেন ত্যাগ করেছে।
কোনো এক সহানুভূতিশীল ব্যক্তি এই অবস্থা দেখে রেল পুলিশে জানান।
তারাই কুন্তলকে হসপিটালে ভর্তি করেন।
কুন্তল সাময়িক সুস্থ হলেও তারপর থেকে মাথার সমস্যা দেখা দেয়। যা কিছু সার্টিফিকেট কাগজপত্র ছিল,সবই সেদিন হারিয়ে ফেলে। তারপর থেকে আরও হতাশায় ভেঙে পড়ে।
ভাবছেন এত কথা জানলাম কীভাবে?
আসলে কুন্তলের বাড়ি আমার গ্রামে। আমার স্কুলের বিষ্টু মাস্টারের ছেলে। স্যারের ছেলেকে অনেক দিন থেকেই চিনি। শুধু চিনি বলব না, যে আমাকে প্রাণের চেয়েও বেশী ভালোবেসে ছিল। সেই কুন্তলই আমার বিবাহিত জীবনে ঝড় তুলে ছিল। অতিষ্ঠ করে দিয়েছিল আমার জীবন। তার কারণ “একগুচ্ছ চিঠি”।
কুন্তলের সাথে আমার পরিচয় চড়কের মেলায়। আমি তখন উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি।
মুখ চেনা কিন্তু কখনো কথা হয় নি । এই প্রথম আলাপ।
আমার কাছে এসে পরিচয় দিয়ে বলল,তুমি তো পড়াশোনায় ভালো। একটা ব্যাংকের চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে। তুমি কি দেবে? আমি সব ফর্ম ফিলাপ করে দেব। “ও “এমনই ছেলে। নিজে শুধু পরীক্ষায় বসে না,অন্যদের ও সুযোগ করে দেয়।
তারপর থেকে প্রায় দেখা, কথা, গল্প হত।
এরই মধ্যে আমার বেসিক ট্রেনিং শুরু।
একবছরের জন্য চলে যেতে হলো মিশনে।ছুটি তেমন ছিল না।
কুন্তল, বন্ধুত্বের হাতটা ধরে বলেছিল, তোমার যা কিছু নোটস লাগবে নির্দ্ধিধায় বলো।
তখন থেকেই আমার সাথে ওর বন্ধুত্বটা আরও গভীর হল।
মাঝে মাঝেই বৌদির হাতে পাঠিয়ে দিত চিঠি। অবশ্য পোস্ট কার্ডে।ক্রমশ চিঠির আকার বড়ো হতে লাগলো। মাঝে মাঝে চার – পাঁচ পাতার বিশাল একটা চিঠি বৌদির হাতে পাঠিয়ে দিত যত্ন করে।
বিষয় ছিল খুব সাধারণ জ্ঞানের কথা, তবে পড়তে খুব ভালো লাগত ।
আমিও লিখে দিতাম প্রতিটি চিঠির উত্তর।
এভাবেই জমে গিয়েছিল একগুচ্ছ চিঠি।
ফোন তো ছিল না। শুধু চিঠি আর চিঠি।
যে কথা বলা যায় না মুখে,সহজেই লিখে ফেলা যায় চিঠিতে।আবেগে ভালো ভালো কথা, ভবিষ্যতের স্বপ্ন সব লিখতাম মন খুলে। কুন্তলও খুব যত্ন করে লিখে পাঠাত শুধু জ্ঞানের কথা। আমাকে অনুপ্রেরণা দিত ওর লেখা চিঠিতে।
জানি না কখন এই চিঠিই একদিন প্রেমপত্র হয়ে গেল।
যেদিন প্রথম ও বলল, তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখছি,সেদিনই ভয় পেয়েছিলাম।
আমাকে নিয়ে স্বপ্ন! এমন ভাবে তো ভাবিনি কখনো।
তাছাড়া আমার জেঠু কোনদিনও মেনে নেবে না এ সম্পর্ক। কারণ কুন্তল তখনো বেকার শিক্ষিত।তার চেয়েও বড় কথা ওরা নিচুশ্রেণীর।তাই আমার বাড়ি থেকে কিছুতেই মানবে না। আমার জেঠুর কথায় শেষ কথা।
তবু ওর এই বন্ধুত্বটা হারাতে খুব কষ্ট হচ্ছিল।
নিজেকে দূরে সরিয়ে নেবার চেষ্টা করেও তাই পারিনি। ওর চিঠির অপেক্ষায় থাকতাম।
তবে চিঠির আর উত্তর দিতাম না।
ট্রেনিং শেষ। বাড়ি ফিরলাম।
একদিন দেখা আমতলার চারমাথায়। শুধু বলল,আমাকে পছন্দ করো না জানি, তাবলে অচেনা হয়ে যেও না। বন্ধুত্বটা রেখো।
যেদিন মাস্টারী পাবে,সেদিন আমায় চিনতে পারবে তো?
আমি চুপ করে ছিলাম। “ও “চলে গেল একরাশ বেদনা নিয়ে।
ভালোবেসেছি কিনা জানি না, তবে ওর চোখদুটো দেখে সেদিন খুব কেঁদে ছিলাম। স্বার্থপরের মতো আমি ওকে শুধু ব্যবহার করেছি। তারপর আর খোঁজ রাখিনি।
আমার লেখা চিঠিগুলো অনেকবার ফেরত চেয়েছিলাম ওর একবন্ধুর দ্বারা।কিছুতেই ফেরত দিল না।
শুধু জানিয়ে ছিল এগুলোই আমাকে লড়াই করার শক্তি যোগাবে।
দীর্ঘ দশ বছর পর–
এখন আমি দুই ছেলের মা।সংসারী। স্কুল শিক্ষিকা। সুখের সংসার আমার।
হটাৎ দেখা স্কুলের সামনে চায়ের দোকানে।
উস্কোখুস্কো চুল,মুখ ভর্তি দাঁড়ি।
সেই চোখ। সেই চুল।টিকালো নাক। পরনে ঢোলা চোস্তা-পাঞ্জাবি। প্রচন্ড ভয় পেলাম।
আমি দ্রুত এগিয়ে এলাম স্কুলের দিকে।পিছন থেকে সাইকেল নিয়ে সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়ালো।
হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বলল, পড়ে দেখো। আমার ৩০ হাজার টাকা চায়।
ভায়ের পড়ার জন্য। না পেলে তোমার লাশ পড়ে যাবে। তোমার লেখা সব চিঠি এখনো আমার কাছে। ”
তারপর থেকে দিনের পর দিন আমাকে ভয় দেখিয়েছে।এ কুন্তল তো আমার সেই বন্ধু কুন্তল নয়। এত ভয়ঙ্কর হতে পারে কখনো ভাবতে পারিনি ।
আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিল। কী করব? কাকে বলব? কিচ্ছু জানি না। স্বামীর কাছেও কিচ্ছু বলতে পারিনি।
হঠাৎ একদিন আমার বাড়ির সামনে এসে হাজির।একই নাম ধরে ডাক দিল। ভয়ে আঁতকে উঠি।
আমার স্বামী চিৎকার শুনে ঘর থেকে বেরিয়ে এল। ওর কাছে গেল। কিছু বলার আগেই দু চার ঘা কষিয়ে দিল। সেই সঙ্গে বলল,
এখুনি যদি চলে না যাও,পুলিশকে জানাতে বাধ্য হবো।
সেদিন লোক জমে গিয়েছিল। সবাইকে জানালো টাকা ধার নিতে এসেছে, পাড়ার মেয়ের কাছে। দেবে না বলতেই রাগ দেখিয়ে উল্টো পালটা গালাগালি দিচ্ছিল। তাই গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হই।
বালিশে মাথা গুঁজে তখনও কাঁদছি। আমার স্বামী কাছে এসে বলল,চিরকুটটা আমি পড়েছি। ভয় পেও না, পাশে আছি। তোমাকে বিশ্বাস করি। কার কাছে কী চিঠি আছে,তা এখন অতীত। তুমিই আমার বর্তমান। চোখের দিকে তাকিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।
জানি না স্যার কীভাবে খবর পেলেন? ঠিকানা খুঁজে ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইতে এলেন আমার বাড়িতে।
আমাকে বললেন,আর চিন্তা করো না। ও আর আসবে না। নিশ্চিন্তে সংসার করো।
পাঞ্জাবীর খুঁটে চোখ মুছতে মুছতে চলে গেলেন।
স্যারের মুখেই শুনলাম শিক্ষিত বেকার পরোপকারী কুন্তলদার বাকি কাহিনী। আমি দশ হাজার টাকা দিয়ে বলেছিলাম, কুন্তলদার ভালো করে চিকিৎসা করান স্যার। এটা আমার গুরুদক্ষিণা ভেবেই গ্রহণ করুন। স্যার মুচকি হেসে বললেন,”ছেলের চিকিৎসার খরচ আমি একাই করতে পারব। তুমি ভালো থেকো মা। ”
সে এখন মানসিক হসপিটালের ১৩ নম্বর রোগী।1
খুব কষ্ট হল । মেয়েদের ডিচ করলে ছেলেরা অপরাধী । ছেলেদের কাছে সুযোগ নিয়ে ছেলেদের পাগলাগারদে পাঠিয়ে মেয়েরাই নিজের সুখের সংসারকে মহিমান্বিত করে রাখার স্বপ্ন দেখে । এসব মেয়েদের কাছে নিজের বিবেক , মানসম্মান এতটাই ঠুনকো? এতটাই মূল্যহীন?